রহমত নিউজ 27 January, 2025 08:13 PM
মাথার মগজের মধ্যে ঢুকে যাওয়া গুলির প্রভাবে ডান হাতে কোনো শক্তি নেই। তবুও মনের শক্তি হারিয়ে যায়নি অমিতের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একদফার দাবিতে রাজপথে মিছিলে শামিল হয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে প্রায় পঙ্গুত্ববরণ করা ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের ১৯ বছরের টগবগে যুবক রংমিস্ত্রি অমিত হাসানের শান্তনা একটাই, দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে।
অমিত হাসান জানিয়েছেন, অমিত হাসান ও তার বড় ভাই আব্দুল হামিদ মহেশপুর পৌরসভার গোপালপুর গ্রামে নানাবাড়িতে বড় হয়েছেন। তার বড় ভাই হামিদও পেশায় রং মিস্ত্রি। অভাব অনটনে নানার বাড়িতে থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে অমিতের। এরপর থেকে অমিত ও তার বড় ভাই হামিদ রং মিস্ত্রির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে অমিত রংমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হয়ে একদফার দাবিতে সোচ্চার হন। জুলাই মাস জুড়ে প্রতিদিন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিছিল করতেন অমিত। এভাবে চলে আসে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ।
আগস্টের ৫ তারিখ দুপুর প্রায় ১২টা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা তখনো পালিয়ে যায়নি দেশছেড়ে। প্রায় ২ হাজার ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনতা মহেশপুর উপজেলা শহরের শাপলা চত্ত্বরে একদফার দাবিতে একাট্টা হয়ে মিছিল বের করে। অমিত এই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন। মিছিলটি মহেশপুর শহরের শাপলাচত্বর থেকে মহেশপুর কলেজ বাসষ্ট্যান্ডে আসার চেষ্টা করলে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলার এক পর্যায়ে পুলিশের ছোঁড়া রাবার বুলেটে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন আন্দোলনকারী আহত হন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক আহত হন অমিত। তাকে প্রথমে মুমূর্ষু অবস্থায় মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে অবস্থার অবনতি হলে যশোর ইবনে সিনহা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অমিতের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা শুরু হয়ে আগস্টের ৮ তারিখ সকাল থেকে। পরে এমআরআই সিটিস্ক্যান করে ডাক্তাররা দেখতে পান অমিতের মাথার মগজে তিনটি মাথার চামড়ার নীচে হাড়ের ভিতরে ১৯টি, গলা মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে ১৬টিসহ মোট ৩৮টি গুলি রয়েছে। এরমধ্যে মাথার মগজের তিনটি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক অবস্থায়। ঢাকা সিএমএইচ এর নিউরো সার্জন ডা. মেজর মোহাম্মদ মুরাদ মাজেদের তত্বাবধানে অমিতের চিকিৎসা চলছে।
বলেছেন অমিতের মগজের তিনটি বুলেট বের করা আদৌ সম্ভব না। দ্রুত বিদেশে নিয়ে গেলে হয়তোবা সম্ভব হতে পারে। মগজের মধ্যে ঢুকে থাকা বুলেটের প্রভাবে অমিতের ডান হাত অবশ ও মুখের কথা এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। বড় ভাই আব্দুল হামিদ আরও জানিয়েছেন, অর্থের অভাবে তার ভাইকে ঢাকায় রেখে চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। ৫ তারিখ থেকে এই পর্যন্ত প্রায় লাখ তিনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্থানীয় আশা এনজিও থেকে চারমাস আগে ৬০ হাজার টাকা ঋণ করা হয়েছে। সেই টাকা কিস্তি আকারে এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। অমিতের খালা জবেদা আক্তার আক্ষেপ করে বলেছেন, ধারদেনা করে বেশি দিন চিকিৎসা চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। মগজের তিনটি বাদে শরীরের বাদবাকি গুলি বের করতে অপারেশন করা লাগবে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। এজন্য পরপর কয়েকটি অপারেশন করা লাগতে পারে। বুলেটের প্রভাবে অমিতের শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। ইদানীং কাউকে ঠিকমতো চিনতেও পারে না। চিকিৎসার কারণে এই পর্যন্ত প্রায় ১৫ বারের অধিক অমিতকে নিয়ে মহেশপুর থেকে ঢাকা যেতে হয়েছে। প্রতিবার যাতায়াত অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে।
তাছাড়া অমিতের ওষুধ বাবদ বর্তমানে প্রতিমাসে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। অমিতের প্রতিবেশী আলী হাসান মন্ডল জানান, বাবা মা থেকেও অমিত আর হামিদ অসহায় এতিমদের মতো। ওদের দেখার কেউ নেই। নানা নানি দু’জনেই মারা গেছে।
রংমিস্ত্রির কাজ করে অমিতের বড় ভাইয়ের পক্ষে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সম্ভব না। ঝিনাইদহ জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম-আহবায়ক মো. আনিচুর রহমান জানান, অমিতের অবস্থা খুবই খারাপ। মগজে বুলেটের অংশের প্রভাবে ওর ডান হাত অচল হয়ে গেছে। অমিতকে জরুরি ভিত্তিতে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য তিনি সরকারেরপাশাপাশি দেশের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানান।